'আত্মহত্যা' বা 'আত্মহনন' শব্দটা শুনলেই আমাদের সমাজের মানুষজন আঁতকে ওঠে। আত্মহননকারীকে শুনতে হয় নানা কটু কথা কিংবা পরিবারকে শুনতে হয় নানা রকমের তির্যক মন্তব্য। কিন্তু গভীরে গিয়ে কেউ দেখে না, কেন একজন আত্মহত্যা করেন বা কেনই বা তারা জীবনের যন্ত্রনা থেকে মৃত্যুর যন্ত্রনাকে বেছে নেয়।
আমাদের এই বাংলাদেশের সমাজ বাকি সমস্ত বিষয়ে খুব সচেতন হলেও এই আত্মহত্যার ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা করে না। কেউ ডিপ্রেশনের কথা বললে বা নিজেদের দুঃখ কারো সাথে ভাগ করলে গদ বাঁধা কিছু কথা শুনে যেতে হয় ।
যেমন- “জীবন অনেক সুন্দর, তাঁকে ভোগ করো।” , “আরে এগুলো কোন ব্যাপার না ,একসময় তুমি নিজেই এগুলো ভেবে হাসবে যে তুমি এসব করেছো”। “ তুমি চলে গেলে পরিবারের কি হবে?” কিংবা “ এগুলো কাপুরুষের লক্ষণ, জীবন মানেই যুদ্ধ , এটা মেনে নিতেই হবে। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না”, “ আরে মেডিটেশন করো”!! ইত্যাদি.. ইত্যাদি..।
প্রশ্ন হচ্ছে লাইনগুলো কি আসলেই একজন আত্মহত্যা প্রবঞ্চনাকারীকে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করতে পারে? উত্তর অধিকাংশ ক্ষেত্রে হবে- 'না'। কারণ এই কথাগুলো সবার ক্ষেত্রে কাজ নাও করতে পারে। ডিপ্রেশনের প্রাথমিক স্তরে এ কথাগুলো হয়তোবা কাজ করে কিন্তু accute depression এর ক্ষেত্রে এই কথাগুলো victim কে আরও বিরক্তির উদ্রেক করে থাকে। এই সম্পর্কে ছোট করে কিছু কথা আলোচনা করা যাকঃ
ডিপ্রেশন আসলে কি?
আপনার মন খারাপ আছে বলেই আপনি ডিপ্রেসড এমন কিছু না। যেকোনো মানুষের মন খারাপ হতে পারে এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মন খারাপ হলেই যে আপনি ডিপ্রেশনে আছেন, সেরকম কিছু ভাবার কোনো কারণ নেই। ডিপ্রেশন এক প্রকারের মানসিক অসুস্থতা যেটা সাধারণত মানুষের মন খারাপ থেকে উৎপত্তি হতে পারে বা অলস জীবন যাপনের কারণে হয়ে থাকে। দুই সপ্তাহ এর বেশি অর্থাৎ আপনি যদি ২০ দিন বা এর বেশি সময় ধরে মন খারাপ, কোন কাজে আগ্রহ পাচ্ছেন না, সব সময় ক্লান্ত লাগছে এবং আপনার পছন্দের কাজগুলো থেকে আপনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, খুব বিরক্ত লাগছে, একা থাকতে ইচ্ছে করছে, কারো সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারছেন না, কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, নিজের ভিতরে অপরাধবোধ কাজ করছে অথচ আপনি অপরাধের কোনো কাজই করেননি, রাতে ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে না বা অতিরিক্ত ঘুমাচ্ছেন, নিজের উপর আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে,এসমস্ত লক্ষণগুলো যদি আপনার ভিতরে ২০ দিনের বেশি সময় ধরে চলে থাকে তাহলে বুঝতে পারবেন যে আপনি ডিপ্রেশনে আছেন বা পড়েছেন।
ডিপ্রেশন কত ধরণের হয়?
ডিপ্রেশন বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে আমি এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্রেশন এর ধরন ব্যাখ্যা করছি।
মেজর ডিপ্রেশন:
এটাকে মেডিকেলের ভাষায় মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বলে থাকে। যদি দিনে আপনি সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন বা ডিপ্রেসড অবস্থায় থাকেন তাহলে এটিকে মেজর ডিপ্রেশন বলা হয়।
লক্ষণ সমূহ:
১ রাতে ঘুমের প্রচন্ড সমস্যা হবে এবং সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকবে।
২: ওজন কমতে থাকবে বা বাড়তে থাকবে।
৩: ভালোলাগার কাজগুলো থেকে আগ্রহ হারিয়ে যাবে।
৪: যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সমস্যা হবে।
৫: নিজেকে অর্থহীন মনে হবে এবং কোন কারন ছাড়াই একটা অপরাধবোধ কাজ করবে।
৬: মাঝে মাঝে আত্মহত্যার চিন্তা ও আসতে পারে
৭: মেজাজ খুব বেশি খিটখিটে থাকতে পারে।
প্রিসিসটেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার:
এই ধরনের ডিপ্রেশন দীর্ঘ সময় অর্থাৎ তাকে দুই বছর বা এর বেশি সময় ধরে যদি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত থাকেন তাহলে বুঝতে হবে এটা প্রিসিসটেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। এ ধরনের ডিপ্রেশন সাধারণত পারিবারিক বা সামাজিক কারণে বেশি হয়ে থাকে।তবে অনেকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকেও হয়ে থাকে।
লক্ষণ সমূহ:
১: তীব্র অনিদ্রা দেখা যাবে বা অতিরিক্ত ঘুম হবে।যারা অতিরিক্ত ঘুমান দিনে-রাতে ২৪ ঘন্টা ঘুমাতে ইচ্ছে করে তাদের এই প্রিসিসটেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
২: কোন কারন ছাড়াই সব সময় মন খারাপ থাকবে।
৩: খাবার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাবে বা খুদা অতিরিক্ত বেড়ে যাবে।
৪: আত্মহত্যার পরিকল্পনা বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা।
৫: সব সময় ক্লান্ত অনুভব এবং কোন কাজে এনার্জি আসবে না।
৬:পছন্দের কাজগুলো থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা ও ব্যবহার ঠিক রাখতে না পারা এবং অতিরিক্ত দ্বিধায় থাকা।
৭: নিজেকে একদম অপদার্থ বা অর্থহীন মনে করা এবং প্রতিটা বিষয়ে আশাহত হওয়া।
৮: আত্মসম্মানবোধ কমে যাওয়া।
সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার:
বছরের কোন কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ডিপ্রেস হয়ে যাওয়া। যেমন অনেকে শীতকালে ডিপ্রেসড হয়ে যায় দিন ছোট হয়ে আসা বা রাত বড় হয়ে যাওয়ার কারণে বা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে। এটি খুবই সাধারন পর্যায়ের একটি ডিপ্রেশন।
সাইকোটিক ডিপ্রেশন:
এ ধরনের ডিপ্রেশন সাধারণত কোন ঘটনা থেকে হয়ে থাকে। যেমন ধরুন কারো পছন্দের ব্যক্তি মারা গেল বা কারো সাথে খুব বাজে কোন দুর্ঘটনা হল, বা কেউ অত্যাধিক ভয় পেল, ইমোশনালি কষ্ট পেলে বা মানসিক ভাবে কোনো আঘাত পেলে, বা চোখের সামনে বড় কোনো দুর্ঘটনা দেখলে।
লক্ষণ সমূহ:
১: হ্যালুসিনেশন (এমন কিছু দেখা শোনা বা অনুভব কর যেটার কোনো অস্তিত্ব নেই)
২: বিভ্রান্তি (কোন কিছুতে ভুল বিশ্বাস থাকা)।
৩: মস্তিষ্কবিকৃতি (সব সময় বা মাঝে মাঝে এরকম অনুভব হতে থাকবে যে কেউ তার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করছে বা ক্ষতি করতে চাচ্ছে)।
৪: দুঃস্বপ্ন।
৫: সবকিছুতেই প্রচন্ড ভয় পাওয়া বা ভয় পেতে থাকা।
ট্রিপিক্যাল বা সাধারণ ডিপ্রেশন:
এটি সাধারণত মানুষের ক্রমাগত মন খারাপ থাকার কারণে এ ধরনের ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ সমূহ:
১: ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
২: অতিরিক্ত ঘুমানোর ইচ্ছা বা ঘুম হওয়া
৩: সমালোচনার উপর একটু বেশী সেনসিটিভ হয়ে যাওয়া
৪: হাত পা ভারী ভারী অনুভব করা।
প্রিমেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার (শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য)
সাধারণত মেয়েদের নিয়মিত বা অনিয়মিত ঋতুস্রাবের পূর্ববর্তী অবস্থায় এ ধরনের ডিপ্রেশন হয়ে থাকে।
লক্ষণ সমূহ:
১: মুড সুইং
২: অ্যাংজাইটি
৩: খাদ্যের রুচির পরিবর্তন
৪: ঘুমের সমস্যা
৫: মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে।
৬: প্রায় সব সময় ক্লান্ত অনুভব হওয়া।
৭ কোন বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে মগ্ন থাকা।
মানুষ কেন ডিপ্রেশনে পড়ে বা থাকে??
একজন মানুষ বিভিন্ন কারণে ডিপ্রেশন আক্রান্ত হতে পারে। এর মধ্যে আমাদের আমাদের বাংলাদেশে পারিবারিক বা সামাজিক কারণে অনেকেই ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মিডিল ক্লাস ফ্যামিলির মানুষজনদের মধ্যে বেশি ডিপ্রেশনের প্রবণতা দেখা যায়।
মানসিক আঘাত বা শারীরিক শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকেও অনেক মানুষ ডিপ্রেশনের পরে।
আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীরা তরুণ-তরুণীরা সবচেয়ে বেশি ডিপ্রেশনের পড়ে থাকে তাদের ফ্রন্টাল লোব বা ক্রিটিভ অংশ এটিকে নিষ্ক্রিয় রাখার কারণে। বিশেষ করে শহর অঞ্চলের কিশোর কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীদের মাঝে এই প্রবণতা অনেক বেশি। তারা দিনের একটা বড় সময় মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের সাথে সময় কাটাচ্ছে। দীর্ঘদিন একটা আবেগ অনুভূতি হীন বস্তুর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার কারণে তারা তারা ডিপ্রেশন এ আক্রান্ত হচ্ছে এবং পাশাপাশি বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধুমাত্র এই মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ এবং নিষ্ক্রিয় জীবন-যাপনের কারণে আমাদের তরুণ সমাজের বড় একটা অংশ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত আছে।
বিভিন্ন রকমের নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবনের কারণে মানুষ ডিপ্রেশনে যায়। যারা প্রতিনিয়ত ধূমপান করে তাদের একটা বড় অংশ ডিপ্রেশনে থাকে। মানুষ বিভিন্ন মানসিক বা শারীরিক কষ্ট দূর করার জন্য ধূমপান বা অন্যান্য মাদক জাতীয় দ্রব্য সেবন করে থাকে তারা ভাবে যে এটি তাদের কষ্টটাকে দূর করছে কিন্তু বাস্তবতা হল এটি তাদের কষ্টটা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়টি বুঝার মত অবস্থা তাদের থাকে না।
এবার আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা নিয়ে অল্প আলোচনা করা যাক। বাংলাদেশের সমাজে এই বিষণ্ণতাকে খুব একটা পাত্তা দেয়া হয় না। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বাংলাদেশের মতন উন্নয়নশীল দেশের খুব একটা চিন্তা নেই। কারণ অনেকেই দারিদ্রসীমার নিচে বা দরিদ্র সীমায় বাস করছেন। মানসিক স্বাস্থ্যের কথা সেখানে চিন্তা করা বিলাসিতা বই আর কিছু না। কথাটা কি সত্য? দেখে নেয়া যাক, সম্প্রতি অষ্ট্রেলিয়ার একটি নামকরা নারীবাদি পত্রিকা যার নাম “ রেস্কিউ অষ্ট্রেলিয়া” এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে টাকা বা অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পদ থেকে মানসিক স্বাস্থ্য অনেক অনেক গুরুত্বপুর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, অনেক অনেক নারী অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় নিজেদের সংসার নিজেরাই ভেংগে দিচ্ছেন এবং পরে একাকি কিংবা অনৈতিক বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে নিজেদের মারাত্মক ক্ষতি করছেন। ইনারা বুঝতে পারছেন না যে স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করা অঢেল সম্পত্তি লাভ করার থেকে অনেক অনেক সুখের এবং মানসিক প্রশান্তির।
আমি বলছি না যে অর্থনৈতিক মুক্তির দরকার নেই কিন্তু তা নিজের মানসিক শান্তিকে বিনষ্ট করে নয়। বাংলাদেশের প্রতি পদে পদেই একজন মানুষকে বিশেষ করে একজন পুরুষকে মারাত্মক মানসিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে গত ১০ বছরের আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে পুরুষদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে বা পাচ্ছে। এর কারণ হিসাবে অনেক কিছুই কাজ করছে তবে অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে পুরুষদের মাঝে ক্যারিয়ারগত এবং সম্পর্কগত জটিলতা। গত এক দশকে সামাজিক সংস্কার এবং মিডিয়ায় প্রচুর পরিমানে নারীকে পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত হিসাবে তুলে ধরায় পুরুষ সমাজে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, শহরাঞ্চলে যৌতুক এখন নেই বললেই চলে। যদিও কেউ নেয় তাঁরা সমাজ এবং পরিচিত মহলে প্রচুর নিন্দা আর কটু বাক্যের সম্মুখীন হতে হয়। এরজন্য প্রধান অবদান অবশ্যই মিডিয়া এবং পুরুষ মানুষদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সমীক্ষায় দেখা গেছে একজন চাকুরীজীবী পুরুষ যৌতুক নেয়াকে নিজের আত্মসম্মানে আঘাত বলে মনে করেন। কিন্তু এখনও এই হাতিয়ার ব্যাবহার করে এখনও প্রচুর লোভী এবং দুশ্চরিত্রের নারী সম্পূর্ণ আইনানুগ ভাবেই পুরুষ নির্যাতন করে যাচ্ছে। যার ফলে এর প্রভাব পড়ছে পুরুষের আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে। কানাডার একটি বিখ্যাত সামাজিক গবেষণা সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে পৃথিবীতে বর্তমানে গড়ে নারীদের তুলনায় পুরুষ বেশী আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকেছে। তবে এই সংখ্যায় নারীরাও কম না। তবে গবেষণায় দেখা গেছে নারীরা সম্পর্কগত জটিলতা থেকে অন্যান্য বিষয়ে বিষন্নতায় ভুগে নিজেদের জীবন শেষ করেছেন। নারীদের বিষন্নতার অন্যতম কারণ হল পরিবারগত জটিলতা, পোষ্ট প্রেগনেন্সি সংক্রান্ত জটিলতা, প্রেম ভালবাসাগত ব্যার্থতা ইত্যাদি।
এইবার আসুন কেন এই বিষণ্ণতা এবং আত্মহত্যা সমাজে বাড়ছে। কারণগুলো দেখে নেই।
এক : আমাদের বাংলাদেশের জনসংখ্যার পুরুষ- নারীর অনুপাত একটি বড় বিষয়। বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশের প্রতি একজন নারীর বিপরীতে ২ জন পুরুষ রয়েছেন। গত শতকে তার হার আরও বেশী ছিল। বর্তমানে এই অনুপাত একটু কম। তবুও নারীদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা যেহেতু বেশী তাই সমাজে শুন্যস্থান থেকেই যায়। পুরুষমাত্রই নারীর প্রতি আকর্ষণ থাকবে। আর সেই নারীকে লাভ করার জন্য পুরুষ সেই প্রাচীনকাল থেকেই অনেক কসরত করে আসছেন। বর্তমানে আধুনিক যুগে একজন নারীর জন্য সম্পর্কের অপশন অনেক। বয়সন্ধিকাল এলেই একজন নারী প্রচুর প্রেমের প্রস্তাব বা বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে থাকেন। একটি ছেলের বেলায় কিন্তু অবস্থা ঠিক তার উল্টো। তাই নারীদের ক্ষেত্রে সম্পর্কগত জটিলতা থেকে উঠে আসা বা এই ব্যাপারে মাথা ঘামানো তাঁদের কাছে এক প্রকার পন্ডশ্রম বটে। পক্ষান্তরে পুরুষের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি অনেক বড় কিছু হয়ে দাঁড়ায় একটি বয়স শেষে। এরজন্যই একজন পুরুষ ক্যারিয়ারের পাশাপাশি তাঁর সম্পর্কেও জোর দিয়ে থাকেন। সম্পর্কে আশানুরূপ ফল না পেলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক পুরুষ ভেঙে পড়েন এবং তা আস্তে আস্তে আত্মহত্যার দিকে ধাবমান হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপার ঘটে থাকে। তবে বর্তমানে তা পুরুষের তুলনায় কম।
দুই : বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা একটু রক্ষণশীল। অনেক নারী যেমন ঘরের বাইরে মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারেন না তেমনি অনেক সামাজিক বিধিনিষেধের ভয়ে নিজেদের ইচ্ছা বা স্বপ্নকে ছুঁতে পারেন না।সামাজিক ব্যবস্থা নারীদের শেখায় নারীদের গৃহস্থালী কাজ করতে হবে নাকি গৃহের বাইরে কাজ করা। একজন নারির স্বপ্ন কি হবে সেটাও ঠিক করে দেয় পরিবার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এইরকম পারিবারিক পরাধীনতা নারিদের উপরে ছোটবেলা থেকেই আরোপ করা হয়। ফলে বড় হবার পর এবং যথেষ্ঠ পড়াশোনা করার পরেও অনেক নারী পরিবারের অন্যায় নিয়ম বা জোর করে চাপিয়ে দেয়া নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। উদাহরণস্বরুপ পাঠকের উদ্দেশ্যে বলি, মনে করুন আপনি একটি বাড়ির মালিক। আপনি কি একজন একা নারীকে বাড়ি ভাড়া দিবেন? কিংবা প্রতিবেশী হিসাবে একজন একা নারীকে রাত ১১টায় মোড়ের দোকানে একা ধূমপান করতে দেখতে পারবেন? অথবা, ভাই হিসাবে একা কোন নারী কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে রাত ১১টায় ঘুরে বেড়াচ্ছে!! ভাবতে পারবেন? না। কারণ সামাজিক ব্যাবস্থা আমাদের এতটাই নিম্নমানের যে নারীর নিজস্ব কোন জগত বা স্বাধীনতা সমাজ দেখতে পারে না বা নারীকে সঠিক সামাজিক সুরক্ষা এই সমাজ দিতে ব্যর্থ। পাওয়া না পাওয়ার মাঝে অনেক নারীকেই শুনতে হয়, যা করবে বিয়ের পর করবে। এখন না। প্রশ্ন হল বিয়ের পরে কেন করতে হবে? বা কেনই বা স্বামীর ঘাড়ে কোন নারীর স্বপ্ন নির্ভর করবে? শিক্ষিত নারী বা আত্মনির্ভরশীল নারী কেন নিজের ইচ্ছামতন তাঁর স্বপ্ন পুরণ করতে পারবে না? নারীর এই চাওয়ার সাথে তাঁর অধিকারের বিস্তর ফারাকের কারণে অনেক নারী বিষন্নতায় ডুবে যান। ফলে এদের কাছে পৃথিবী সাদাকালো মনে হতে থাকে। সব শেষে এরা মৃত্যু যন্ত্রনাকেই বেছে নেন।
তিন : পুরুষ নারী উভয়ই আজকাল শিক্ষিত। সমস্যা হল বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যতগুলো আছে এর তুলনায় ভালমানের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে বিশাল সংখ্যক যুবক বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছে। নারীদের কেউ কেউ প্রবাসী বিয়ে করছেন বা বেকার থাকা অবস্থায়ই সফল পুরুষের ঘরের স্ত্রী হয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। সমস্যায় পড়ে যাচ্ছেন পুরুষেরা। বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টর ৯৫%ই ঢাকা কেন্দ্রিক। সেখানে কাজ করছেন অনেক নারী। তবে তার সংখ্যা বিবেচনা করলে পুরুষের তুলনায় খুব নগন্য। মফস্বল বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসা ক্ষেত্র ছাড়া তেমন কোন স্থানে নারীদের সফল আনাগোনা চোখে পড়ে না। পক্ষান্তরে, পুরুষদের একটা বিরাট অংশ বেকার হয়ে জীবন পার করছেন। যাদের অর্থনৈতিক জোর আছে এরা উচ্চ শিক্ষার নামে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। কিন্তু সেখানে থেকেও অনেকেই বিষন্নতায় ভুগছেন কারণ সেখানের একাকী জীবন আর কঠিন বাস্তবতা যা এরা দেশে থাকা অবস্থায় অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন।
পরিশেষে ডিপ্রেশন কাটানোর কিছু টিপসঃ
ডিপ্রেশনের বিভিন্ন স্টেজ থাকে পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় আপনি ডিপ্রেশনের কোন স্টেজে আছেন সেই অনুযায়ী আপনার চিকিৎসা নিতে হবে। আমি কিছু প্রাথমিক ট্রিটমেন্টের কথা আলোচনা করছি।
১: সাইকোথেরাপি.
আপনি আপনার সমস্যাগুলো কোন একজন সাইকোলজিস্ট বা থেরাপিস্টের সাথে কথা বলবেন তিনি আপনাকে বিভিন্ন টাস্ক বা পরামর্শ দিবেন সেগুলোর মাধ্যমে আপনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
২: লাইট থেরাপি:
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং খুবই উপকারী। যারা মনে করছেন যে আপনি ডিপ্রেশনে আছেন তারা একটু বেশি সময় সূর্যের আলোতে কাটাবেন।সূর্যের আলো আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখে। যেমন সকাল থেকে দুপুর বারোটা একটা পর্যন্ত এ সময়টিতে সূর্যের আলো আমাদের জন্য খুবই উপকারী।
৩: ব্যায়াম: পুরুষদের জন্য (দৌড়ানো, পুশ আপ, পুল আপ, সাঁতার কাটা, সাইকেলিং, ওয়েট লিফটিং), মেয়েদের জন্য (হাটা, দড়ি লাফ, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, সাইকেলিং,)
এই ব্যায়াম আপনাকে ডিপ্রেশন থেকে খুব সহজে বের হয়ে আসতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি আপনার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
৪: মেডিসিন:
একজন অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট আপনার ডিপ্রেশন এর মাত্রা অনুযায়ী আপনাকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দিতে পারে।
৫: প্রাণী পালন:
বিড়াল, কুকুর এবং খরগোশ এই প্রাণীগুলো মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এবং মানুষের আবেগ অনুভূতির সাথে সহজেই মিশে যেতে পারে।যারা খুব বেশি ডিপ্রেশনে আছেন তারা এই প্রাণীগুলো পালন করতে পারেন।
৬: খাদ্য :
বিভিন্ন রকমের খাবার আছে যেগুলো আপনাদের ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে তবে হ্যাঁ শুধু এই খাবারগুলো খেলেই আপনার ডিপ্রেশন কমে যাবে এরকমটা ভাবেন না।(ডালিম, আপেল, কিসমিস, আখরোট কলা, দুধ, সবুজ শাকসবজি, মাছ)
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার ৪০ মিনিট আগে ১০/১২ টা কাঠবাদাম খেতে পারেন।
৭: ঘুম:
একজন মানুষের দৈনিক ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। এবং রাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুমোতে যাবেন। ঘুমের সময় মোবাইল থেকে দূরে থাকবেন। সহজেই ঘুম আসবে।
৮: ড্রাগস:
অবশ্যই ধূমপান বা অন্যান্য যে কোন নেশা জাতীয় দ্রব্য আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে যদি আপনি ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি চান এটার কোনো বিকল্প নেই। যারা আপনাকে এইসব খেতে উৎসাহ দেয় এরা কখনই আপনার ভাল চায় না। মনে রাখবেন সিগারেট বা যেকোন মাদক আপনার অবস্থা আরও খারাপের দিকে নিবে। ভাল কিছু করবে না।
৯: মেডিটেশন:
অনেক সাইকলজিস্ট কিংবা যোগ গুরু আপনাকে মেডিটেশনের কথা বলবেন এবং পদ্ধতিও দেখিয়ে দিবেন। এটা খুব কার্যকরী এবং অনেক সময় একদম শুরুর দিকের ডিপ্রেশনে এই পদ্ধতি কাজ করে। তবে একিউট ডিপ্রেশনে এই পদ্ধতি কাজ নাও করতে পারে।
১০: ট্রাভেলিং:
আপনি এমন কোথাও থেকে ঘুরে আসুন যে জায়গাটা আপনার পছন্দের বা কোনো এক সময় সে জায়গাটিতে আপনার যেতে ইচ্ছে হয়েছিল।সাথে আপনার ভালোবাসার মানুষ যদি থাকে উনাকে নিয়েও যেতে পারেন।
১১: প্রেমের ব্যার্থতায় নিজেই নিজের ডাক্তার
আপনি যদি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে থাকেন এবং আপনার প্রাক্তন প্রেমিক আপনার সাথে প্রতারনা করে থাকেন, ভুল বোঝে থাকেন অথবা আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনাকে ত্যাগ করে থাকেন তাহলে হতাশ হবেন না। ভেবে দেখুন, সে কি আপনার মতই দুঃখে আছে নাকি সে তাঁর লাইফে মজা করছে? যদি উত্তর ২য়টা হয় তাহলে আপনি কেন দুঃখ পাচ্ছেন? নিজেকে প্রশ্ন করেন। দ্বিতীয়ত, ভেবে দেখুন সে কি ততটাই আপনাকে ভালোবাসতো যতটা আপনি বাসছেন? উত্তর হল না। যদি সে বাসতো তাহলে আপনার সাথে কথা বলে সমস্যা ঠিক করার চেষ্টা করতো। সে কি তা করেছে? না করলে আপনি কিভাবে সেই ব্যাক্তির জন্য নিজেকে শেষ করছেন? তৃতীয়ত, আপনার ব্রেণ আপনাকে বোকা বানাচ্ছে, আপনার ব্রেইন selective retention করছে। মানে শুধু ভাল ভাল স্মৃতিগুলো আপনাকে মনে করাচ্ছে কারণ সে ভাল বোধ করতে চাইছে। কিন্তু সেইগুলা মনে করাচ্ছে না যখন আপনি উনাকে নিয়ে চরম বিরক্ত ছিলেন, আপনাদের মাঝের বিস্তর ফারাকগুলো মনে করাচ্ছে না, বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমতগুলো মনে করাচ্ছে না যা আপনার চরম বিরক্তির উদ্রেক করতো। তাছাড়া আপনি যেসব স্মৃতি মনে করে সমানে কান্না করে নির্ঘুম রাত পার করছেন, অনেক স্মৃতি আপনার ব্রেণ বানিয়ে বা অতিরঞ্জিত করে বলছে। আপনি যদি আসলেই সেই স্থানে গিয়ে দেখতেন তাহলে পার্থক্যটা সহজেই বুঝতে পারতেন। যার জন্য আপনি মরছেন বা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন একবার ভেবে দেখুন, এতে কি সে আপনার জন্য আফসোস করবে? না। সে ঠিকই অন্যের হাত ধরে জীবন পার করবে। তাই আপনিও আপনার সুজোগ নষ্ট কেন করবেন? মনে রাখবেন আপনার যে প্রাক্তন ছিল সে মোটেও অনন্য অসাধারণ কেউ ছিল না। আপনি নিজেকে বার বার যা বলছেন এতে লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো আপনি নিজেকে নিজে ব্রেণ অয়াশ দিচ্ছেন। আপনার সাথে যে ছিল ওর মতন মানুষ পৃথিবীতে ভর্তি। ভুলে যাবেন না পৃথিবীতে প্রায় ৮ বিলিওন মানুষ বাস করে। ট্রিলিওন মানুষ পৃথিবীতে মারা গিয়েছেন। কাজেই এদের মাঝে শুধু একজনের কারণে আপনি শেষ এমন চিন্তা করাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ? বরং এর থেকেও ভাল সঙ্গী চারপাশে ভরা। আপনি শুধু একটু খুজে নিতে হবে। আপনি ছেলে হলে এই প্রসেসে সময় লাগতে পারে। সেটা বিষয় না। অবশ্যই পাবেন কাউকে না কাউকে। তাই হতাশ হবেন না। নিজেকে ভালোবাসুন। যে আপনার ভালবাসা না বুঝে চলে গেছে তাঁকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেকে নষ্ট করবেন না।
পৃথিবীর আর কোন তরুণ প্রাণ যেন এই আত্মহত্যায় প্রাণ না হারান এবং আর কেউ যেন ডিপ্রেশনে নিজেকে শেষ না করেন। মানুষের নৈতকতার চরম স্খলনের কারনেই আজ অনেক তরুন প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে। বন্ধ হোক এই রাহুর গ্রাস, সকল তরুন প্রাণ বসন্তের ফুলের মতই সুগন্ধ ছড়াক চারিদিকে।
শ্রী অভিজিৎ প্রতাপ রায়
গবেষক এবং বেসরকারী সংস্থায় চাকরিরত।
ইমেলঃ [email protected]